জীবনের অপর পৃষ্ঠা (পর্ব-৫৬)

লেখক – কামদেব

[ছাপ্পান্ন]
—————————

           এখন পাড়ায় গরম খবর বঙ্কিম– সর্বত্র গুজ গুজ ফুস ফুস।বিষয়টা চ্যারিটি দপ্তরে এসেছে।উমানাথকে সমস্ত ব্যাপার বঙ্কিম খুলে বললেও উমানাথ চিন্তিত।বয়স্কদের কিভাবে বোঝাবে।সুলতা গোজ হয়েছিল,প্রথমে কিছুই বলতে চায়নি।কিন্তু দাদাদের হম্বিতম্বিতে চেপে রাখা সম্ভব হয়নি।মেজদা তিমির নরম প্রকৃতি সমীরের মত গোয়ার নয়।সে তো পারলে বঙ্কা শালাকে খুন করে।সুলতা বলল,তোমরা আমাকে মারো, বকুকে কিছু বলবে না।
তিমির বলল,সমু মাথা গরম করিস না,এখন মাথা গরম করার সময় না।
–তুমি বলছো কি মেজদা?মাথা গরম করব না?
–দেখ একহাতে তালি বাজে না।তিমির বলল।
–মেজদা আমি ভালবাসি,–।সুলতা বলল।
–চুপ কর।ভালবাসলে এই সব করতে হবে?কিছু করেনা বেকার ছেলে–।
–ও চেষ্টা করছে,কিছু একটা ব্যবস্থা হবেই।
–কি ব্যবস্থা হবে?হতচ্ছাড়ি বংশে কালি দিয়ে দিল।আমার শ্বশুরবাড়ীতে কি করে মুখ দেখাবো–? বড়দি মমতা খিচিয়ে ওঠে।
সুলতার বড় বোন মমতা।বিয়ের পর  কলকাতায় থাকে।খবর পেয়ে ছুটে এসেছে।
–আঃ মমতা উত্তেজিত হলে হবে।চ্যারিটিতে খবর দিয়েছি।দেখা যাক ওরা কি করে?অনেক বিচক্ষন লোক আছেন  চ্যারিটিতে।মা কি করছে?তিমির বোনকে থামায়।
–কি করবে,কাদছে।মার কথা বলিস না মেজদা।এতকাণ্ডের পর বলছে ওর সঙ্গেই বিয়ে দিতে।মমতা বলল।
–ছোড়দি তুই আর কথা বলিস না,ভেবেছিস জানিনা কিছুই?সুলতা ফুসে উঠল।
সমীর ঠাষ করে এক চড় বসিয়ে দিল,–কি জানিস তুই কি জানিস?
তিমির বলল,কি হচ্ছে কি এতবড় মেয়ের গায়ে কেউ হাত তোলে?
সুলতা ককিয়ে উঠল,মেরে ফেল আমাকে মেরে ফেলো।মেজদা ঐ গুণ্ডাটাকে বলো আমাকে মেরে ফেলতে।
মমতা আর কথা বলেনা।বিয়ের আগে ঐটা ছাড়া দিব্যেন্দু  কিইনা করেছে। ব্যাটা বেইমান, ব্যাঙ্গালোরে যাবার আগে বলেছিল ফিরে এসে ফয়সালা করবে।হারামীটা বলতো মমু তোমাকে ছাড়া বাচবো না। ব্যাঙ্গালোর থেকে ফিরে বাপ-মায়ের ঠিক করা পাত্রীকে বিয়ে করে বউ নিয়ে ব্যাঙ্গালোর চলে গেল।শালা এখন অন্য মেয়েকে বিয়ে করে দিব্যি বেচে বর্তে আছে। রাগে দুঃখে ভেবেছিল আত্মহত্যা করবে।মেজদা ছিল বলে সবদিক ভালোয় ভালোয় মিটে গেল।মেজদাই সুবোধের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেছিল।
সুবোধ ব্যাঙ্কে চাকরি করে।মমতাকে খুব ভালবাসে,ওর মাই যা দজ্জাল।কদিন আর বাচবে বুড়ি, চুপ করে সহ্য করে যায়।তবে নাতি অন্তপ্রাণ।সুলতা পেট বাধিয়ে বসেছে এখন উপায়?
অফিস থেকে ফিরে একে একে জড়ো হয়।চ্যারিটির অফিস জমজামাট।সুলতার মেজদা তিমির এবং বঙ্কার মামা সুরেনবাবুও এসেছেন।সকলকে অবাক করে উপস্থিত হয়েছেন ডাক্তারবাবু।সভা শুরু হতেই প্রচণ্ড বাদ-প্রতিবাদ পারস্পরিক দোষারোপ।হাল ধরলেন, অবসর প্রাপ্ত বিচারক আর এন চৌধুরী।তিনি শুরু করতেই সভায় নীরবতা নেমে এল।জাস্টিস চৌধুরী বলতে থাকেন, দুজনেই ছেলে মানুষ নয় প্রাপ্ত বয়স্ক এবং যা করার নিজ নিজ সম্মতিতে করেছে।আইনের চোখে অপরাধ বলতে পারিনা।
তিমির বলল,স্যার আপনি ঠিক বলেছেন কিন্তু ছেলেটি বেকার নিজের কোনো সংস্থান নেই বউকে কি খাওয়াবে?আপনারা কি বলেন বোনকে জেনেশুনে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেব?
জাস্টিস চৌধুরি হেসে বললেন,ভাই আপনি আবেগ প্রবন হয়ে পড়েছেন।আপনার মনের অবস্থা বুঝি।ছেলেটি বেকার গ্রাজুয়েট,এখন কিছু না করলেও না খেয়ে নেই।আজ বেকার কাল কোন কাজ করবে না এটা যুক্তি হিসেবে মেনে নেওয়া যায় না।
তিমিরের মনে হল বিয়েটা মেনে নেওয়াই ভাল।তাছাড়া না মেনে উপায় কি?
মোটামুটি সভা যখন শেষ হতে চলেছে গোল পাকালেন সুরেনবাবু।উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ভগ্নীপতি মারা যাবার পর দিদির দায় তার উপর বর্তেছে।ভগ্নীপতির পেনশন ছাড়া সংসারে দিদির কিছু দেবার সামর্থ্য নেই।কিন্তু নিজের দিদিকে তো ফেলে দিতে পারেন না কিন্তু আরেকটা মেয়ের দায়িত্ব তিনি নিতে পারবেন না,সাফকথা।
সভায় গুঞ্জন শুরু হল কেউ সুরেনবাবুর উপর বিরক্ত আবার কেউ বলল,ঠিকই আজকালকার বাজারে উনি আরেকটা সংসার কিভাবে প্রতিপালন করবেন।ওর নিজেরও সংসার আছে।সবাইকে থামিয়ে ড শরদিন্দু ব্যানার্জি উঠলেন।তিনি একটু ভেবে বললেন, আমি মেয়েটিকে চিনি না কিন্তু বঙ্কিম পাড়ার ছেলে ভদ্র নম্র, মানুষের সুখে দুখে পাশে দাড়াতে দেখেছি।আজকাল চাকরি পাওয়া সহজ ব্যাপার নয়।জাস্টিস চৌধুরির সঙ্গে একমত আজ না হোক কাল পাবে।শুনলাম মেয়েটির যা অবস্থা কবে চাকরি পাবে তার জন্য বসে থাকা যায় না।
কে একজন বলল,একমাস।বেলা চৌধুরি ধমক দিল,চ্যাংড়ামী হচ্ছে?
আমি একটা প্রস্তাব দিচ্ছি,আমার কম্পাউডার আছে যদি বঙ্কিম রাজি থাকে তাহলে যতদিন চাকরি না হয় কম্পাউডারের সহযোগী হিসেবে কাজ করতে পারে।
উমানাথ বলল,ডাক্তারবাবু বঙ্কিম রাজী আছে।
ডাক্তারবাবুর কানে একটা কথা যেতে উনি বললেন,আমার যিনি কম্পাউণ্ডার তার দুটি  বাচ্চা আছে তিনি যা পান তাতেই সংসার চলে যায়।প্রকাশ্যে বলব না কত পায়।
জাস্টিস চোউধুরী বললেন,ডাক্তার আমার এবং সভার পক্ষ হতে আপনাকে অভিনন্দন। মেয়ে কবে যাচ্ছে?
–ভিসা পেলেই চলে যাবে।
বাইরে বেরিয়েই হিমেশ ধরল,এই বঙ্কা চা খাওয়াতে হবে।
বঙ্কিমের মন ছটফট করছে সুলতার জন্য।বেচারি কত কষ্ট পাচ্ছে কে জানে।এখন বাড়ির বাইরে বেরোয় না।সবাই চায়ের দোকানে গেল,উমানাথ বেলাবৌদির সঙ্গে কি কথা বলছে বলল,তোরা যা আমি আসছি।
সুদীপ বলল,ব্যাস গেটপাস হয়ে গেল বঙ্কা এবার সরাসরি বাড়ীতে গিয়ে দেখা কর।
দিন পনেরো পর শুভ দিন দেখে বঙ্কিম এবং সুলতার বিয়ে হয়ে গেল।এক রকম চাদা তুলেই বিয়ে বলা যায়।সুরেনবাবুর বাড়ীতে জায়গা হয়নি বঙ্কিম উঠেছে বস্তিতে।সুলতার মনে ক্ষোভ নেই বস্তি হলেও বকুকে পেয়েছে।কপালে থাকলে বস্তি জীবনও ঘুচতে পারে।একটাই আক্ষেপ মেজদা ছাড়া বাড়ীর কেউ যোগাযোগ রাখে না।বকু গরীব হতে পারে দিবুদার মত  বেইমান নয়।
মাস খানেক পরের কথা।শুভর বিয়ে হয়ে গেল ধুমধাম করে।পাড়ার প্রায় সবাই আমন্ত্রিত এমন কি সস্ত্রীক বঙ্কিমও।কনের সাজে দারুণ লাগছিল রোজিকে।বিয়ের পর  হনিমুনে যাবার তোড়জোড় চলছে।নেপাল না দার্জিলিং এই নিয়ে চলছে কথাবার্তা। সোমলতার বিয়ে হলেও সে ডা.শরদিন্দু ব্যানার্জির কাছে ফিরে এসেছে।ওর স্বামী এফআরসিএস করতে বিলেত গেছে।ভিসার আবেদন করেছে পেলে সোমলতাও যাবে তার তোড়জোড়  চলছে।একটা দুঃখ জনক খবর মিসেস মুখার্জি অসুস্থ হয়ে নার্সিং হোমে ভর্তি হয়েছিলেন, খবর পেয়ে পলি মলি এসেছিল।কিন্তু এসে মাকে জীবিত দেখতে পারেনি।সৎকার করে আবার এ্যামেরিকায় ফিরে গেছে।পারমিতার বিয়েও ঠিক।ছেলে মুম্বাইয়ে সফটওয়ার ইঞ্জিনীয়ার, বিয়ের পর তাকে মুম্বাই যেতে হবে।
আল্পনা বিয়ে বাড়ী থেকে ফিরে অনুযোগ করে,তুমি কোনোদিন আমায় কোথাও নিয়ে গিয়েছো?
–শুভর শ্বশুরবাড়ী থেকে কত কি দিয়েছে দেখেছো?
–এতদিন পরে সেই খোটা দিচ্ছো?
–এতদিন পরে তুমিই বা ওসব কথা বলছো কেন?কিভাবে সংসার চলছে জানো না?
–জানি বলেই বলছি।এতদিন কি  বলেছি?রতি এখানে থাকে না ওর অংশটা–।
–চুপ একদম চুপ।ভগবান তোমাকে কি একটু লজ্জা শরম দেয়নি?
আলপনা ফুপিয়ে কেদে ফেলে।
খুশবন্ত দার্জিলিং-এ এসপির দায়িত্ব নিয়েছে,চাচাজীদের সঙ্গে কথা হয়েছে ওরা আম্মীকে প্লেনে তুলে দেবে।বাগডোগরা হতে সে নিয়ে আসবে।কথাটা শুনে রতির প্রতিক্রিয়া বোঝা গেলনা।একবার মনে হয়েছিল রতিকে সঙ্গে নিয়ে যাবে বাগডোগরা।পরে মনে হল আগে দেখা যাক আম্মী বিয়ের ব্যাপারটা কিভাবে নেয়।
আম্মীর আসার দিন মোহন ছেত্রীকে নিয়ে একাই রওনা হল।আম্মি ভেরি স্মার্ট সেজন্য নয় বয়স হয়েছে বিশাল শরীর নিয়ে আগের মত হাটতে চলতে পারে না।দমদম নেমে আবার প্লেনে উঠতে হবে। বাসায় রতি একা একা কি করছে কে জানে?
–সাব চা আনবো?মোহন জিজ্ঞেস করল।
–হ্যা একটু চা খেলে টেনশন কমবে।
মোহন ছেত্রী চা এনে দিতে চুমুক দেয়।রতির ব্যাপারটা আম্মী কিভাবে নেবে ভাবতে ভাবতে দূরে দাঁড়ানো মোহনজীর দিকে চোখ পড়তে মনে মোহনজীকে না আনলেই ভাল হত।
মোহনজী এসে খবর দিল প্লেন আসছে।
খুশবন্ত চায়ের ভাঁড় ফেলে এক্সিট গেটের দিকে এগিয়ে গেল।বিশাল চেহারা সাদা চুল সহজেই নজরে পড়ে।চোখাচুখি হতেই আম্মী হাত নাড়ল।দলজিৎ বেরোতে খুশবন্ত এগিয়ে আম্মীর হাত থেকে লাগেজ নিয়ে নিল।আম্মী কোনো কষ্ট হয়নি তো?
–বাতের ব্যথাটা না থাকলে কোনো সমস্যা হতো না।
মোহন ছেত্রী এগিয়ে এসে স্যারের কাছ থেকে ট্রলি ব্যাগটা নিয়ে জিপে তুলে দিল।খুশবন্ত বলল,মোহন জী আপনি সামনে বসুন।
আম্মীকে নিয়ে পিছনে বসল খুশবন্ত।
জিপ ছুটে চলেছে পাহাড়ী পথ ধরে।দলজিৎ বললেন,সুখবীরের পরিবার কোথায় শুনেছে তোর সাদি হয়েছে।
–ট্রান্সপোর্ট ব্যবসায়ী?
–ওদের আরো ব্যবসা আছে।
–কলকাতা থেকে খবর পেয়েছে হয়তো।
–ভাঙ্গানী দেবার লোক তো কম নেই।
–ভাঙ্গানী নয় কথাটা সত্যি।কথাটা যেন খুশবন্তের ঠোটের ডগায় শুরশুর করছিল।
দলজিৎ অবাক হয়ে বলল,মতলব? না নাচা না গানা সাদি হয়ে গেল?
–একবার তো অনেক নাচা গানা বাজনা আম্মী অনেক হয়েছে।অন্যদিকে তাকিয়ে বলল খুশবন্ত।
দলজিৎ কিছু বলতে গিয়ে একেবারে চুপ।জিপ পাহাড়ী পথ ধরে সামনে এগোতে থাকে দলজিতের মনটা পিছন দিকে হাটতে থাকে।আড়চোখে আম্মীকে দেখে অবস্থাটা অনুমান করার চেষ্টা করে।

চলবে —————————