জীবনের অপর পৃষ্ঠা (পর্ব-৫৭)

লেখক – কামদেব

[সাতান্ন]
—————————

      জিপ ঘুমে ঢূকে পড়েছে পথ আর অতটা খাড়াই উৎরাই নয়।খুশবন্ত মনে মনে ভাবে ভুমিকা হয়ে গেল এবার আসল কথায় আসতে হবে।দলজিতের চোখ ছলছল করছে।খুধবন্ত জিজ্ঞেস করে,কি ভাবছো আম্মি?
–সরদারজী ধাক্কা সামলাতে পারেনি এত তাড়াতাড়ি যেতো না।
–বাপুর কি দোষ?
–হারামীরা এখন চাক্কি পিষছে।
–এতদিনে  সবার জামীন হয়ে গেছে খবর পেয়েছি।
–লেড়কা কি করে চাকরি না বিজনেস?
–কিছু করে না।আমাকে ভালোবাসে বহুত বহুত ভালোবাসে।খুশবন্ত এমন ভাব করে দেখে দলজিতের হাসি পেয়ে যায়।
দলজিত বয়সের অভিজ্ঞতায় জানে মেয়েরা কখন এমন দিওয়ানা হয়ে যায়।জিজ্ঞেস করেন,মহব্বত?
–আমাদের পুরানো পাড়ার ছেলে ছোটো বেলা থেকে আমাদের মহব্বত।
–নাম কি আছে?
–রত্নাকর।
দলজিৎ অতীত হাতড়ায়।নামটা শুনা শুনা লাগছে।
–পূজার পর তোমাকে প্রণাম করতে আসতো।
–উমা–।
–হ্যা উমানাথ আউর রত্নাকর।
–কিন্তু পুত্তর বেকার ছেলে–।
–রাইটার কাহানী লেখে।কিছুতেই রাজী হচ্ছিল না ডাটতে রাজী হয়ে গেল।
মেয়ের কাণ্ড শুনে দলজিতের হাসি পেয়ে গেল।এতবড় চাকরি একটা বেকার ছেলেকে ভয় দেখিয়ে বিয়ে করেছে।ছেলেটীকে দেখার জন্য কৌতুহল বাড়ে।
বাংলো সংলগ্ন এসপি অফিস।বাংলোর কাছে আসতে বলল,মোহনজী আপনি অফিসে যান,আমি আসছি।
বাংলোর কাছে পৌছে হর্ণ বাজাতে রত্নাকর দরজায় এসে দাড়ালো।সুন্দর স্বস্থ্যবান চেহারা মনে হচ্ছে এই ছেলেটা হবে।খুশবন্ত বলল,কি দেখছো আমার আম্মী।
রত্নাকর নেমে ট্রলিব্যাগ নিয়ে বলল,আসুন আম্মী।
সিড়ি দিয়ে উঠতে রত্নাকরের কাধে ভর দিয়ে উঠতে থাকেন দলজিৎ।
নীচ থেকে খুশবন্ত বলল,আম্মী তুমি রেস্ট নেও আমি অফিসে যাচ্ছি।
রত্নাকর ধরে ধরে এনে একটা সোফায় বসিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল,এক্টু চা দিই।
রান্না ঘরে গিয়ে কান্তাকে বলল,চা সঙ্গে কিছু পকোড়া ভেজে দাও।
এখানকার আবহাওয়া বেশ ভালো লাগে।রাস্তা একটু খাড়াই উৎরাই।দরজা বন্ধ করে ট্রলিব্যাগ খুলে চেঞ্জ করতে থাকেন।দরজায় শব্দ হতে বললেন,এক মিনিট।
পোশাক বদলে দরজা খুলে দেখলেন ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে কান্তা।
–তুমি ও কোথায় গেল?
–পাশে আছে লেখাপড়া করছে।
দলজিত ট্রে নিয়ে পাশের ঘরে গেলেন।দলজিৎ চা দিয়ে রত্নকরের পাশে বসেন।বাংলা বুঝলেও পড়তে পারেন না,বড় আফশোস।রতির গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,চা পিও পুত্তর।
রতি একটু মমতার স্পর্শ পেলে আবেগ প্রবণ হয়ে পড়ে।কলম রেখে দলজিতের হাত চেপে নিজের গালে বুলায়।দলজিতের খুব ভাল লাগে ওর মুখে আম্মী ডাক শুনতে।জিজ্ঞস করেন,এখানে বসে আছো আমাকে চিনতে পারোনি?
–আপনি গুরুদ্বারে যেতেন কত দেখেছি।আসলে না লিখলে মুন্নি বকাবকি করবে।হঠাৎ খেয়াল হতে রত্নাকর বলল,ইস প্রণাম করা হয়নি,নীচু হয়ে প্রণাম করল।
–ঠিক আছে পুত্তর।দলজিৎ মাথায় হাত রেখে বললেন।
–আপনি আমার মায়ের মতো প্রণাম করবো না?
–তুমি পড়াশুনা কতদূর করেছো?
–গ্রাজুয়েশন করেছি।লাজুক গলায় বলল।
–চাকরি করো না কেন?
–মুন্নি করতে দেয় না।খালি লেখালিখি করতে বলে।
–লেখালিখি করলে টাকা পাওয়া যায়?
–হ্যা যত বই বিক্রী হবে তত রয়াল্টি।
–কি রকম হয়?
–মুন্নি জানে আমাকে বলে না। আম্মী একটা কথা বলব কিছু মনে করবেন না।
–মুন্নি আমাকে আপনি বলে না।
রত্নাকর হাসল।কি বলবে বলছিলে?
–মুন্নি আপনার মেয়ে তবু বলছি–।
দলজিৎ গম্ভীর কিছু একটা ইঙ্গিত পাচ্ছেন।বললেন,বেফিকর বলো পুত্তর।
রত্নাকর বলল,মুন্নি কারো কথা শোনে না।বহুৎ জিদ্দি। অফিস গেল ফিরে এসে রান্না ঘরে ঢুকবে।তাহলে কান্তা কি করবে?
দলজিৎ স্বস্তির শ্বাস ফেললেন।মনে মনে হাসেন একেবারে ভোলেভালা মানি যেইসা।অভিযোগের মধ্যে অনুরাগের স্পর্শ কান এড়ায় না।বিয়ে নিয়ে যত দুশ্চিন্তা ছিল এখন অনেকটা আশ্বস্থ বোধ করেন।
খুশবন্ত জিপ নিয়ে রাউণ্ডে বের হয়।এই এসপি আসার পর থেকে থানাগুলো তটস্থ।সীমান্ত অঞ্চল অবাধে চোরা চালান হতো,অনেক টাকার লেনদেন।অন্যদিনের চেয়ে আজ একটু সকাল সকাল ফিরে এল।দুশ্চিন্তা ছিল আম্মী এসেছে রতিকে কিভাবে নেবে।পয়সাওলা পাত্র ঠিক করেছিল হাত ফসকে গেল।
খুশবন্ত বাংলোয় ঢুকে কারো সাড়া শব্দ না পেয়ে রান্না ঘরে গিয়ে কান্তাকে জিজ্ঞেস করল,আম্মি কোথায়?
–সাহেবের ঘরে।
কপালে ভাজ পড়ে সকাল থেকে রতির সঙ্গে কি করছে?যে আশঙ্কা মনের মধ্যে মেঘের মত জমেছিল মেঘ সরে আকাশ পরিস্কার।নিজের ঘরে গিয়ে চেঞ্জ করে বিশ্রাম করতে থাকে।মনে হচ্ছে দুজনের খুব জমেছে।রতির মধ্যে একটা মায়া আছে সকলেই ওকে ভালোবাসে।সেটাই খুশবন্তের সমস্যা,আগলে আগলে রাখতে হয় সব সময়।আগোছালো অলস সাজিয়ে মিথ্যে বলতে পারেনা মানুষকে সহজে বিশ্বাস করে।যাক আম্মীকে নিয়ে চিন্তা দূর হঠাৎ খেয়াল হয়।অনেক বেলা হল খেয়েদেয়ে তাকে আবার বেরোতে হবে।একজন বয়স্কা মহিলার সঙ্গে কি এত কথা নাওয়া-খাওয়ার হুশ নেই।খুশবন্ত উঠে রতির স্টাডি রুমে গিয়ে বলল,কি লাগানি ভাঙ্গানি হচ্ছে?
রত্নাকরের চোখে মুখে বিপুল বিস্ময় দলজিতকে সাক্ষী মেনে বলল,দেখেছো আম্মি ওর কথা তোমাকে কিছু বলেছি?আমরা অন্য কথা বলছিলাম–।
–লেখা বাদ দিয়ে অন্য কথা?
–মুন্নি আমার খাতির আজ কিছু বলিস না।দলজিৎ রতিকে আড়াল করেন।
–যাও স্নান সেরে নেও,সেই কখন বেরিয়েছো স্নান করলে ফ্রেশ লাগবে।
খুশবন্ত সাবান তোয়ালে এগিয়ে দিল দলজিৎ বাথ্রুমে ঢূকলেন।দলজিৎ নিজেকে নিরাবরণ করে শাওয়ারের নীচে দাড়াতে গিজারের উষ্ণ ধারা যেন সমস্ত ক্লান্তি গা বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে।বাড়ীতে আসতো সর্দারজী না থাকলে,সর্দারজীকে এড়িয়ে চলতো। ছেলেটাকে ভালো লেগেছে সুন্দর কথা বলে।সুন্দর মন থেকে সুন্দর কথা আসে।সরদারজী তাকে ভালোবাসতো কিন্তু চাইতো আনুগত্য। মুন্নি চায়না তাই চাকরিতে আগ্রহ নেই।দলজিৎ হেসে ফেলেন। 

উশ্রী কদিন ধরে বলছে চলো না কোথাও ঘুরে আসি।উমানাথ বুঝতে পারে শুভ যাচ্ছে শোনার পর থেকেই নতুন বায়না শুরু হয়েছে।দাদা-বৌদিকে রেখে বউ নিয়ে বেড়াতে যাবার কথা ভাবতে পারেনা উমানাথ।
মনীষা বলল,যাও না ঠাকুর-পো,কোনোদিন তো কোথাও যাওনি।
–তাহলে চলো সবাই মিলে।
–বাড়ী ফাকা রেখে?তোমার সঙ্গে যাবো কেন?গেলে আমি আর তোমার দাদা অন্য কেউ নয়।
দিদির বলার ভঙ্গী শুনে খিল খিল করে হেসে উঠল উশ্রী।উমানাথ বলল,কিন্তু শুভ যাচ্ছে এই সময়ে কি–।
–শুভ যাচ্ছে তো কি,দার্জিলিং কি এইটুকু জায়গা?যাও রতির সঙ্গে দেখা হবে,কত ভালবাসত তোমায়।
রতির কথা শুনে উমানাথ দুর্বল হয়।সেদিন ভাল করে কথা বলা হয়নি।বলল,দেখি টিকিটের কিছু করা  যায় কিনা?
–তোমার বসকে বোলো,উনি তো শুনেছি পর্যটন দপ্তরে আছেন।মনীষা মনে করিয়ে দিল।
উমানাথের  মনে হল অফিস থেকে বাড়িতে গেলে বিষয়টা আরো গুরুত্ব পাবে।যেই ভাবা সেই কাজ।উমানাথ ঠিকানা খুজে  সাহেবের বাড়িতে হাজির হল।বাড়ীতেই ছিলেন,দেখেই চিনতে পারলেন।সব কথা বলতে উনি বললেন সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।হোটেলে উঠতে হবেনা পর্যটন দপ্তরের বাংলোয় ব্যবস্থা করে দেবেন।জিজ্ঞেস করলেন,আচ্ছা ঘোষ আপনার সেই বন্ধু স্যাণ্ডিকে পড়াতো উনি নাকি এখন লেখক?
–অনেকদিন ধরেই লেখে।এবারের পুজো সংখ্যায় ওর একটা উপন্যাস ছাপা হয়েছে।
রতির বিয়ে হয়ে গেছে বলতে গিয়েও বলল না।যাক টিকিটের জন্য এসেছিল থাকার বন্দোবস্তও হয়ে গেল।এক মহিলা আড়াল থেকে অদ্ভুত চোখে দেখছিলেন,উমানাথ ভেবেছিল স্যারের স্ত্রী।কিছুক্ষন পর একজন মহিলা চা নিয়ে ঢুকলেন।স্যার বললেন,অঞ্জনা ইনি আমার অফিসে আছেন ভেরি এফিসিয়েণ্ট।ইনি আমার মিসেস।ভদ্র  মহিলা হাত জোড় করে নমস্কার করলেন।উমানাথও প্রতি নমস্কার করল।
অফিসে যেমন গম্ভীর স্যার বাড়ীতে একেবারে অন্যরকম।উমানাথের ভালো লাগে।ঐ মহিলা তাহলে স্যারের স্ত্রী নয়।
এই লোকটা আনন্দের পরিচিত,আনন্দের খবর হয়তো কিছু বলতে পারবেন।রঞ্জনা সুযোগ খুজছিল একটু একা কথা বলার।রাগিনীর কাছে শুনেছে আম্মাজী সব রকম চেষ্টা করছেন আনন্দকে ফিরিয়ে আনার।আনন্দ নিজে লুকিয়ে নাকি কেউ তাকে আটকে রেখেছে এই নিয়ে আশ্রমে ফিসফাস আলোচনা হয়।এবার লোকটা উঠবে রঞ্জনা এই মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছিল।জাম্বু লোকটিকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বলল,ঘোষ যাও ঘুরে এসো।ভালো লাগবে।
–আসি স্যার।
মি গুপ্ত দরজা বন্ধ করে ফিরতে রঞ্জনাকে দেখে বললেন,তুমি কোথাও বেরোবে নাকি?
রঞ্জনা হাসি টেনে বলল,এখন কোথায় বের হবো।
রাস্তায় নামতে একটা বাস পেয়ে গেল।ছুটির দিন ভীড় নেই,কিছুক্ষন পরেই বসার জায়গা পেয়ে গেল।কোন কাজে সফল হলে মনটা হালকা লাগে।বিয়ের পর উশ্রীর এই আবদার রাখতে পেরে ভালো লাগে।

চলবে —————————

Leave a Comment